শীলভদ্র (৭ম শতক) বৌদ্ধ পন্ডিত। সমতটের এক ব্রাহ্মণ রাজবংশে তাঁর জন্ম। নবদ্বীপ বা বিক্রমপুরস্থ রামপাল তাঁর জন্মস্থান বলে অনুমান করা হয়। ভারতবর্ষের নানা স্থান পরিভ্রমণশেষে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে তিনি ‘দন্ডদেব’ নামে আখ্যাত হন। বসুবন্ধুর অনুগামী শীলভদ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ধর্মপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি দাক্ষিণাত্যের জনৈক ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন। তাঁর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে মগধরাজ শীলভদ্রকে যে পারিতোষিক দান করেন, তা দিয়ে তিনি একটি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করেন।
শীলভদ্র বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র ব্যতীত বেদ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। ৬৩৫ খিস্টাব্দে তিনি নালন্দা মহাবিহারের প্রধান আচার্য ও সর্বাধ্যক্ষের পদ লাভ করেন। সংঘবাসিগণ তাঁকে ‘সদ্ধর্মনিধি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে নালন্দায় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্ তাঁর নিকট যোগশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। অপর এক চৈনিক পরিব্রাজক হুই লি বলেন, শীলভদ্র সব বৌদ্ধশাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন। তিববতের তেঙ্গুরে তাঁর আর্যবুদ্ধভূমিব্যাখ্যান গ্রন্থের অনুবাদ সংরক্ষিত আছে শীলভদ্র সম্পর্কে জানার প্রধান উপায় বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ -এর বিবরণী। তাঁর গ্রন্থে স্থান না পেলে শীলভদ্র সম্পর্কে কোনোকালেই জানা হয়তো সম্ভব হতো না। হিউয়েন সাঙ প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শীলভদ্রের ছাত্র ছিলেন। উভয়ে উভয়ের জীবনঘনিষ্ঠ; পিতা-পুত্রের সম্পর্কসম। হিউয়েন সাঙ ভারত থেকে নিজ দেশে প্রত্যাগমন করে চীন সম্রাটের অনুরোধে বৌদ্ধধর্ম ও ভারত ভ্রমণের বিবরণ সম্বলিত ‘সি ইউ কি’ নামক তথ্যবহুল একটি গ্রন্থ চীনা ভাষায় রচনা করেন। ‘সি ইউ কি’ গ্রন্থটি আধুনিককালে চীনে বৃটেনের সাবেক রাষ্ট্রদূত স্যামুয়েল বিল কর্তৃক বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন যে, হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় প্রাচীন বাংলাদেশসহ প্রাচীন ভারতবর্ষের ভৌগলিক ও সামাজিক, রাজ-ইতিহাস ও সাস্কৃতিক চিত্র সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর বর্ণনার মুখ্য বিষয় হলো, ভারতসহ বিভিন্নজনপদের নামকরণ, দেশের পরিমাণ, নগর ও গৃহাদির বিবরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, লিপি-ভাষা-বিদ্যা ও গ্রন্থের বিবরণ, শিক্ষা, সামাজিক প্রথা, আচার-ব্যবহার, শাসনপ্রথা ও রাজস্বাদির পরিচয়, এমনকি গাছপালা, খাদ্যদ্রব্য, তৈজসপত্র বা রতরাজিদেরও তিনি পরিচয় দিয়েছেন।
সমতট তথা সে সময়ের কুমিল্লা সম্পর্কে হিউয়েন সাঙের জীবন্ত বর্ণনা এরকম : এখানে নিয়মিত চাষাবাদ হয়। প্রচুর শস্য আর ফলমূল সর্বত্রই জন্মায়। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ আর লোকদের স্বভাব হচ্ছে ভদ্র। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী, লম্বায় কম আর এদের গায়ের রং কালো। এরা প্রবল বিদ্যানুরাগী আর বিদ্যালাভ করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করে। সত্য আর মিথ্যা এই দুই সিদ্ধান্তেরই লোক এখানে থাকে।’ কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি অঞ্চলে ২টি বড় বিহারসহ ছোট-বড় ৩৫টি বিহার দেখেছেন বলেও হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেন এবং এ স্থানকে তিনি ‘দি সিটি অব দ্যা ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় নগরী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশে মুসলিম বিজয়ের পূর্বেকার ভারত তথা বাংলাদেশের ধারাবাহিক লিখিত ইতিহাস খুব একটা পাওয়া যায় না, সে কারণে হিউয়েন সাঙের মতো জগৎখ্যাত বিদেশী মনীষীদের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখিত বিবরণ আধুনিক পন্ডিতদের কাছে বিশুদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
শীলভদ্র শৈশবেই জ্ঞান অন্বেষণে গভীর অনুরাগী ছিলেন। ২০ বৎসর বয়স পর্যন্ত সমতট রাজ্যের রাজধানী বা প্রধান কেন্দ্র অর্থাৎ লালমাই-ময়নামতিতে অবস্থান করেন; প্রারম্ভ শিক্ষা সেখানেই। নিজ রাজ্যের শিক্ষায় পুরোপুরি জ্ঞান পিপাসা মিটাতে পারেন নি। তাই, কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ শীলভদ্র রাজকীয় সম্মান ও ঐশ্বর্যত্যাগ করে অধিকতর জ্ঞান অন্বেষণের জন্য ভারতবর্ষের বহু শিক্ষাকেন্দ্র পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধধর্মসহ সার্বজনীন শিক্ষায় তিনি সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি ভারতের নালন্দায় উপস্থিত হয়ে সেখানে ছাত্র হন। নালন্দায় যখন শীলভদ্র ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন তখন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার বয়স আনুমানিক দুইশত বৎসর পেরিয়েছে। তখন নালন্দা মহাবিহারের বোধিসত্ত্ব ধর্মপাল। ধর্মপাল যোগাচার (বিজ্ঞানবাদ) দর্শনের একজন অসাধারণ প-িত ছিলেন। ধর্মপালের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সুবাধে তাঁর সংস্পর্শে এসে শীলভদ্র অনুরক্ত শিষ্য হন এবং নানা বিষয়ে দীক্ষা লাভ করেন। ধর্মপালের নিকট থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা শুনে শীলভদ্র মুগ্ধ হন। ধর্মপালের ধর্মজ্ঞান ও ব্যক্তিগত গুণাবলী অতি সহজেই শীলভদ্র আয়ত্ত করে নেন।
শীলভদ্রের পান্ডিত্যের খ্যাতি তখন দূর দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ওই সময় দাক্ষিণাত্যের একজন দিকবিজয়ী ব্রাহ্মণ পন্ডিত মগধ রাজ্যের (ভারতের বর্তমান বিহার এলাকা) রাজার দরবারে হাজির হন। ধর্ম বিষয়ে ধর্মপালের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তাব দাখিল করেন। মগধ রাজা তখন ধর্মপালকে তলব করেন। ধর্মপাল তখন রাজদরবারে গমন করার প্রস্ততি নিলেন। এমন সময় শীলভদ্র নিজেই তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে সুযোগ দেয়ার জন্য ধর্মপালকে অনুরোধ করেন। ধর্মপাল বলেন, ‘বৌদ্ধধর্মের সূর্য অস্তমিত হতে চলেছে। চারদিকে বিধর্মীরা মেঘের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দূর করতে না পারলে সৎ ধর্মের কোনো উন্নতি নেই।’ শীলভদ্র আবার বললেন, ‘গুরুদেব আপনি অবস্থান করুন। আমি সেই সভায় গমন করছি।’ রাজদরবারে হাজির হলেন শীলভদ্র। তাঁকে দেখার পর দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ পন্ডিত তাচ্ছিল্য করলেন। কিন্ত অল্পক্ষণের মধ্যেই ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন শীলভদ্র। কোনো যুক্তির খন্ডন কিংবা বচনের উত্তর দিতে না পেরে পন্ডিত লজ্জিত অবস্থায় রাজদরবার ত্যাগ করেন। শীলভদ্রের অসাধারণ পান্ডিত্য ও বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে মগধ রাজা শীলভদ্রকে একটি নগরের রাজস্ব উপহার দিলেন। শীলভদ্র রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন।
#biography
#Shilbhadra
#history
#facts
#bangla
![](https://i.ytimg.com/vi/TP9OrCjvdCU/maxresdefault.jpg)