রামায়ণের সর্বশ্রেষ্ট বাংলা অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা (১৩৮১-১৪৬১)
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে পনের শতকের প্রধান কবি ও বাংলা রামায়ণের আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা। তাকে বাল্মিকীর রামায়ণের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক বলা হয়। মৈথিলি ব্রাহ্মণদের অসমিয়া ভাষায় ওঝা বলা হয়। ওঝা শব্দটি এসেছে ‘উপাধ্যায়’ থেকে।
কৃত্তিবাস ওঝা রাজশাহী জেলার অন্তর্গত প্রেমতলীর কাছে, মতান্তরে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গঙ্গাতীরবর্তী ফুলিয়া গ্রামে ১৩৮১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বনমালী ওঝা এবং পিতামহ মুরারি ওঝা ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত।
গৃহশিক্ষা শেষ করে মাত্র ১২ বছর বয়সে কৃত্তিবাস জ্ঞানার্জনের উদ্দেশে উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ করেন। সেখানে বরেন্দ্রের বিশিষ্ট পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষা শেষ করে ১৪১৫-১৮ সালের দিকে রাজপণ্ডিত হওয়ার উদ্দেশ্যে গৌড়েশ্বর রাজা গণেশ, মতান্তরে সুলতান জালালউদ্দীন মাহমুদ শাহর দরবারে গিয়ে তাকে নানা শ্লোক পাঠ করে শোনান। গৌড়েশ্বর শ্লোক শুনে মুগ্ধ হন এবং কবিকে বিভিন্ন উপঢৌকনে সম্মানিত করেন এবং রামায়ণ রচনা করতে অনুরোধ করেন। তখন বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণ অনুসরণ করে কৃত্তিবাস পয়ার ছন্দে বাংলা রামায়ণ রচনা করেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ ১৮০২ থেকে তিন সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে সর্বপ্রথম পাঁচ খণ্ডে মুদ্রিত হয়। তারপর জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ১৮৩০-৩৪ সালের মধ্যে দুখণ্ডে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত রামায়ণের যতগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে শ্রীরামপুরের প্রথম সংস্করণের পাঠই সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়।
কৃত্তিবাসের পরে আরও অনেকে বাংলায় রামায়ণ রচনা করেছেন, কিন্তু খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারেননি। বাঙালি পাঠক-শ্রোতা যুগযুগ ধরে রামকাহিনী থেকে ধর্ম, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন, নীতিজ্ঞান, শাস্ত্রজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে আসছে। বিশেষত রামকাহিনীকে অবলম্বন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তা আজও অটুট রয়েছে।
কৃত্তিবাসের কবি পরিচয়
কৃত্তিবাসী রামায়ণের কোনো কোনো পুঁথি থেকে ‘কৃত্তিবাসের আত্মপরিচয়’ শীর্ষক একটি অসম্পূর্ণ অধ্যায় পাওয়া যায়। ‘রামায়ণের’ কোনো কোনো সংস্করণে মুদ্রিত ‘আত্মবিবরণী’ থেকে কৃত্তিবাসের সময় নির্ধারণে সাহায্য নেওয়া হয়। এই আত্মবিবরণীটির প্রামাণিকতায় অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। অনেকে এটিকে আধুনিক কালের রচনা বলেও মনে করেন। কিন্তু সব কিছুর পরও এর মধ্যেই কৃত্তিবাসের পরিচয় আছে বলেই মনে হয়। মনে হয় কৃত্তিবাসের মূল রচনাটিতে আধুনিক কালের কেউ অনেক কিছু জুড়ে দিয়েছেন। এটি ছাড়া কৃত্তিবাসের সম্পর্কে অন্য কোনো কিছু থেকে জানবারও উপায় নেই।
এই ‘আত্মবিবরণী’ অনুসারে কৃত্তিবাস বলেছেন, বঙ্গদেশে (বর্তমানে বাংলাদেশে) বেদানুজ নামে এক রাজার সভায় নরসিংহ ওঝা পাত্র বা সভাসদ হিসেবে কাজ করতেন। রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে নরসিংহ ওঝা সপরিবারে কর্মস্থল বঙ্গদেশ ত্যাগ করে গঙ্গার তীরে ফুলিয়া গ্রামে বসতি করেন। নরসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর; গর্ভেশ্বরের তিন পুত্রের জ্যেষ্ঠের নাম মুরারি; মুরারি অনেক পুত্রের মধ্যে একজনের নাম বনমালী, ইনিই কৃত্তিবাসের পিতা। এইভাবে বংশপরিচয় দিয়ে কৃত্তিবাস নিজের জন্ম সম্পর্কে লিখেছেন।
জন্মের পর উত্তম বস্ত্রে জড়িয়ে পিতা শিশুকে কোলে নিলেন, পিতামহ নাম রাখলেন কৃত্তিবাস। এগার বছর কেটে বারোতে পা দিলে তিনি ‘বড়গঙ্গা’ বা পদ্মানদী পার হয়ে উত্তরদেশে গেলেন বিদ্যার্জন করতে।
বিদ্যার্জন শেষ করে গুরুকে দক্ষিণা দিয়ে কৃত্তিবাস ঘরে ফিরতে মনস্থ করলেন। এক মঙ্গলবারে তিনি গুরুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন, গুরু তাকে প্রশংসা ও আশির্বাদ করলেন। কৃত্তিবাসের ইচ্ছা তিনি রাজপণ্ডিত হবেন। তাই তিনি গেলেন গৌড়ের রাজ দরবারে। সাতটি শ্লোক লিখে তিনি দ্বার রক্ষীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন রাজার কাছে এবং অনুমতির অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজা তখন রাজদরবারে বসেছেন। দরবার শেষ হলে দ্বাররক্ষী ফিরে এসে রাজার কাছে নিয়ে যান।
ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অনেক তথ্যের সন্ধান মেলে। সেখানে বলা হয়েছে, কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা ছিলেন পূর্ববঙ্গের বেদানুজ রাজার অমাত্য। তাঁরা ছিলেন ‘মুখুটি’ (মুখোপাধ্যায়) বংশজাত রাঢ়ীয় বা রাঢ়দেশীয় ব্রাহ্মণ। পারিবারিক শিক্ষকতা বৃত্তির জন্য ‘উপাধ্যায়’ পদবি লোকমুখে বিকৃত হয়ে হয় ‘ওঝা’। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নরসিংহ ওঝা কর্মস্থল ত্যাগ করে নদিয়ায় চলে এসে ফুলিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কৃত্তিবাসের মায়ের নাম ছিল মালিনী।
![](https://i.ytimg.com/vi/lxc92ZTjbFc/mqdefault.jpg)